স্বদেশ ডেস্ক:
দুলাভাই গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ শ্যালক সাইফুল করিম খান। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক উন্নয়নকাজ করেছেন তিনি। সেসব কাজ দেখভালের দায়িত্বে খোদ প্রকৌশলী দুলাভাই। এই ‘দুলাভাই’য়ের নাম মো. আবুল কালাম। তিনি গণপূর্ত বিভাগের ইএম সার্কেল-৩ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। শ্যালক-দুলাভাইয়ের সিন্ডিকেট নিয়ে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের মধ্যে অসন্তোষ এবং ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধরা।
এদিকে দুলাভাইয়ের যোগসাজশে অনিয়ম ও অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়ায় শ্যালক সাইফুল করিমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। অভিযুক্ত সাইফুল আলম খানকেও চিঠির মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ জানানো হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের অভিযোগ ও কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম ও তার
শ্যালক সাইফুল করিম মিলে অবৈধভাবে শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি প্রকৌশলীরা ঠিকাদারি ফার্ম করতে পারেন না। এ কারণেই আবুল কালাম শ্যালক সাইফুলের নামে একটি ঠিকাদারি ফার্ম খুলেছেন। ফার্মটির নাম ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস। এ ঠিকাদারি ফার্মের অনুকূলে সিসিটিভি, নেটওয়ার্কিং, সাউন্ড সিস্টেম ও পিএবিএক্সের কাজ দিতে অন্যান্য সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলীদের চাপ দেন কালাম। কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী তার কথা না শুনলেই তাকে হয়রানিমূলক বদলি করাচ্ছেন। এমনকি চাকরি খেয়ে ফেলারও হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রকৌশলীরা। একইভাবে তার শ্যালককে কাজ না দেওয়ায় একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে ইএম/৮ বিভাগ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেসের প্রোপ্রাইটর সাইফুল করিম খানকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রকৌশলী সৈয়দ ইসকান্দার আলী বলেন, টেন্ডার প্রাইস ফিক্সিং একটি যোগসাজশমূলক অপরাধ। দরপত্রের অনুমোদিত প্রাক্কলিত মূল্য আপনি যোসসাজশ করে জেনেছেন, যা যোগসাজশমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য। অনুমোদিত প্রাক্কলনটির অধিকাংশ আইটেম নন-শিডিউল আইটেম। অনুমোদিত প্রাক্কলনের কপি গণপূর্ত ই/এম সার্কেল ৩-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম পৃষ্ঠাঙ্কন করে নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ প্রাক্কলনের অনুমোদিত মূল্য তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩ এবং নিম্নস্বাক্ষরকারী উভয়েই জ্ঞাত। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত প্রাক্কলিত মূল্য জানে না এবং জানার কথাও নয়। কিন্তু টেন্ডার ওপেনিংয়ের পর দেখা যায় যে, আপনার ফার্ম ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য যে কোনোভাবে যোগসাজশ করে জেনে সুস্পষ্টভাবে ১০ ভাগ লেস মিলিয়ে দিয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় আপনি অনুমোদিত মূল্য পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে জেনেছেন। ওই কাজের মাধ্যমে দরপত্রের আইটিটি ক্লাউস ৪-এর ৪.২ (সি) অনুযায়ী আপনি পিইর জ্ঞানের বাইরে কলুসিভ প্র্যাকটিস করেছেন। এবং ৪.৩ মোতাবেক তা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে।
দুদকে দেওয়া অভিযোগ এবং নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবুল কালাম আজাদ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালার (পিপিআর) শর্ত ভঙ্গ করে শ্যালকের ঠিকাদারি ফার্ম ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেসের নামে কাজ দিয়ে টেন্ডার অনুমোদন করেছেন। এমনকি বেশ কিছু টেন্ডারে মূল্যায়নে পর্যালোচক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি তার অধীন কাঠের কারখানা বিভাগে ৮ কোটি, মেকানিক্যাল কারখানা বিভাগে ৪ কোটি, ইএম বিভাগ ৭-এ ১২ কোটি, ইএম বিভাগ ৮-এ ৬ কোটিসহ মোট ৩০ কোটি টাকার অধিক কাজ প্রদান করেছেন। এ ছাড়া প্রভাব বিস্তার করে শ্যালককে বিপুল অঙ্কের কাজ পাইয়ে দেন আবুল কালাম। সব মিলিয়ে উন্নয়নকাজের পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। কয়েকজন প্রকৌশলী বলছেন, রাজস্ব বাজেটে ১২ লাখ টাকার প্রাক্কলন পাস করার বিধান থাকলেও আবুল কালাম ১২ লাখ টাকার ঊর্ধেŸর ২ কোটি টাকার প্রাক্কলন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই পাস করেছেন। তার অধীনে অন্তত অর্ধশতাধিক কাজ করেছেন শ্যালক সাইফুল করিম।
এ নিয়ে একটি তদন্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা। সে আলোকে দুলাভাইয়ের অধীনে শ্যালক সাইফুল করিম খান কী পরিমাণ কাজ করেছেন এবং অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত লিখিত দিয়েছিলেন প্রকৌশলীরা। তবে এর পর আর এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গণপূর্ত ই/এম কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ইসকান্দার আলী বলেন, ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাইফুল করিম খান। তিনি অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে এর আগেও তদন্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, টেন্ডার প্রাইস ফিক্সিং অপরাধ। কিন্তু একটি কাজে শুধু সাইফুল করিমই নির্দিষ্ট প্রাইস দিয়েছেন। প্রাক্কলিত মূল্য ঠিক হওয়ার সুযোগ নেই। এভাবে সব কিছু ফাঁস করে দিলে কাজে ফেয়ার থাকে না। আমি তাই লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েছি। এখন দেখা যাক ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা।
এ অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেসের প্রোপ্রাইটর সাইফুল করিম খান বলেন, আমি কোনো ধরনের চিঠি পাইনি। আর আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নেই।
গণপূর্ত বিভাগের ইএম সার্কেল-৩ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামকে বিভিন্ন সময়ে ফোন দিলেও প্রতিবারই নম্বর ব্যস্ত দেখায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল দিলে কেটে দেন। এর পর তার মোবাইল নম্বর এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পরিচয় দিয়ে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। সরকারি কোনো কর্মকর্তা নিজ বা আত্মীয়স্বজনের নামে ঠিকাদারি করতে পারেন না। অভিযোগের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’